সেলিম চৌধুরী নিজস্ব সংবাদদাতাঃ-বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জন্ম : ৫-৫-১৯১১ ইং – আত্মদান: ২৪-৯-১৯৩২ ইং।ভারতের মুক্তিসংগ্রামে কুমারী প্রীতিলতা অগ্নিযুগের প্রথম মহিলা শহীদ। তিনি ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সফলভাবে সে দায়িত্ব পালনের পর রাত ১২টা অতিক্রম হয়ে ঘড়ির কাঁটা ২৪ সেপ্টেম্বরে প্রবেশ করার অল্প কিছুক্ষণ পরেই প্রীতিলতা আত্মাহুতি দিয়ে অমরত্ব লাভ করেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে।প্রীতিলতা ১৯১১ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম শহরের বালিকা বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে ঢাকায় ইডেন কলেজ-এ ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ছাত্রীদের মধ্যে প্রথম এবং ছাত্রী-ছাত্রদের মধ্যে ৪র্থ স্থান দখল করেন। তারপর তিনি কলিকাতায় গিয়ে বেথুন কলেজে বি.এ-তে ভর্তি হন।সেই সময়ে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে কলিকাতার আলীপুর সেন্ট্রাল জেল-এ ফাঁসির প্রতীক্ষায় ছিলেন। প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের ভগ্নি পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁর কথায় বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ হন। প্রীতিলতা বি.এ পাস করে চট্টগ্রামে ফিরে শহরের নন্দনকানন বালিকা বিদ্যালয়-এ প্রধান শিক্ষয়িত্রীর পদ গ্রহণ করেন এবং মাস্টারদার সাথে সংযোগ স্থাপন করেন।১৯৩২ সালের ১৩ জুন মাস্টারদা সূর্য সেন ধলঘাট গ্রামের একটি আত্মগোপন কেন্দ্রে প্রীতিলতাকে ডেকে নেন। সেদিন রাতেই সেই বাড়িটি পুলিশ ও ফৌজের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়ে। সেই গোপন কেন্দ্রে চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম নেতা নির্মল সেন এবং অপূর্ব সেনও ছিলেন। বিপ্লবীদের সাথে সংঘর্ষে ব্রিটিশ ফৌজের একজন ক্যাপ্টেন নিহত হয় এবং নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন শহীদ হন। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে নিয়ে বেষ্টনী ভেদ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।তখন চট্টগ্রাম ইউরোপীয়ান ক্লাব ছিল সরকারি ও ফৌজী অফিসারদের ভারতবিরোধী ষড়যন্ত্রের একটি কেন্দ্র। এই ক্লাবটি আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল বহু আগেই। ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ প্রথম আক্রমণের পরিকল্পনা নিলেও গুড্ ফ্রাইডে হওয়ায় সেদিন ক্লাব বন্ধ ছিল। তাই আক্রমণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ক্লাব আক্রমণের এই পরিকল্পনা ইংরেজ ও ইউরোপীয়ানরা জেনে যায়। সেই থেকে উক্ত ক্লাবে নাচগান ও খেলাধুলা প্রায় বন্ধ করে দেয়। এরপর শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে রেলওয়ে এলাকাস্থ পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাবে সশস্ত্র রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে সেখানেই তাদের সান্ধ্য ও নৈশ আনন্দ উচ্ছ্বাস এবং খেলাধুলার আয়োজন চলছিল। বিপ্লবীরা পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। তখন এই ক্লাবের অনতিদূরে দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে বিপ্লবী শান্তি চক্রবর্তীর নেতৃত্বে বিপ্লবীদের একটি ঘাটি গড়ে ওঠেছিল। অদূরে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমিতে বিপ্লবীরা গোপনে ও নিরাপদে পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল শিক্ষাগ্রহণ করতে থাকে। কারণ গুলির শব্দকে সমুদ্রের গর্জন বিলীন করে দিত। পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণের সব আয়োজন চলে এই কাট্টলী গ্রাম থেকেই।পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য প্রথমে বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীর উপর দায়িত্ব দেয়া হয়। নানাকারণে এই তরুণ বিপ্লবী পর পর দু’বার পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণে ব্যর্থ হন। ব্যর্থতার বেদনা সহ্য করতে না পেরে শৈলেশ্বর চক্রবর্তী এক রাতে কাট্টলীর সমুদ্রতীরে গিয়ে নিজের রিভলবার দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এভাবে তিনি যে আত্মহত্যা করবেন বিপ্লবী নেতা মাস্টারদা থেকে শুরু করে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে কেউ ভাবতেও পারেন নি। তিনি আত্মদানের পূর্বে মাস্টারদার কাছে একখানা চিঠি লিখে যান। তাতে তিনি তাঁর ক্লাব আক্রমণের ব্যর্থতার কথা প্রকাশ করেছিলেন।
এরপর স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীরাও যে নেতৃত্ব দিতে পারে, তা প্রমাণ করার জন্য মহানায়ক সূর্য সেন ঐ ইউরোপীয়ান ক্লাবটি আক্রমণ করার দায়িত্ব প্রীতিলতার উপর ন্যস্ত করেন। তিনি বলেছিলেন–“বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপুল পর্যন্ত এদের দৃপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্ত বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেল। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই-আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগত জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছিয়ে নেই।এই উদ্দেশ্য নিয়ে মাস্টারদা পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণের কিছুদিন পূর্বে একবার দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামে আসেন। ওখানে আলাপের জন্য আসবার পথে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সালে পাহাড়তলীতে ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পড়েন। প্রীতিলতা নিরাপদে কয়েকদিনের মধ্যে সেখানকার গোপন কেন্দ্রে আসেন। মাস্টারদা তাঁকে জানিয়ে দেন যে, তাঁর নেতেৃত্বে ২৩ সেপ্টেম্বর (১৯৩২ ইং) পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে। শুনে প্রীতিলতা খুবই আনন্দিত হন এবং কাট্টলী সমুদ্র সৈকতে গিয়ে বোমা ছোঁড়া ও গুলিতে লক্ষ্যস্থির করার শিক্ষাগ্রহণ করতে শুরু করেন। নির্ধারিত দিনে মাস্টারদা একজন দেহরক্ষী নিয়ে আবার ওখানে রাত পৌনে দশটায় হাজির হন। ক্লাব আক্রমণের জন্য প্রীতিলতার নেতৃত্বে অন্য যেসব বিপ্লবী নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁরা হলেন- শান্তি চক্রবর্তী, কালীকিঙ্কর দে, সুশীল দে, প্রফুল্ল দাস, পান্না সেন, বীরেশ্বর রায়, মহেন্দ্র চেীধুরী। রাত দশটায় পূর্ণ সামরিক বেশে সজ্জিত হয়ে প্রীতিলতা ও অন্যান্য বিপ্লবীরা সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্লাব আক্রমণের জন্য বেরিয়ে যান। আগে থেকে ক্লাবের সম্পর্কে পূর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে ক্লাবের বাবুর্চি মনসুর আহমদের কাছ থেকে পূর্ণ তথ্য বিপ্লবীরা যোগাড় করেছিলেন। প্রীতিলতা বিপ্লবীদের নিয়ে ক্লাবের কাছাকাছি বেশ নিরাপদেই চলে আসেন। সেখানে গিয়ে একটু ঝোপের মত জায়গায় কিছুক্ষণ তাঁরা আত্মগোপন করে থাকেন। সেখান থেকে তাঁরা দেখতে পান যে ক্লাবে তখন ‘বল’ নাচ চলছে এবং সশস্ত্র প্রহরী দরজায় দাঁড়ানো।